“আইয়ুব বাচ্চু কেন এভাবে কাঁদালেন আমায়?”

মিলি সুলতানা, কুইন্স, নিউইয়র্ক থেকেঃ

৯০ দশকে খবর গ্রুপের ছায়াছন্দ মনোরমা ও চিত্রবাংলায় লিখতাম আমি। বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম মনোরমায় লিখে। লেখার অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান ভাই। আমার লেখায় কোনও কাঁচি চলবে না — এই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকেই। আমিও লেখার নানা উপকরণ পেতাম। চলচ্চিত্র সামাজিক রাজনৈতিক ফিচার প্রবন্ধ সব লিখতাম। এলআরবি মাইলসের দারুন জনপ্রিয়তা। ঢাকায় গিয়ে মাইলসের শাফিন আহমেদের সাক্ষাতকার নিলাম। যদিও হামিন আহমেদের সাথে আমার আগেই পরিচয় ছিলো। হামিন আহমেদ কলকাতায় শো করতে গিয়ে সুন্দর স্টাইলে একটা ছবি তুলে ছবির পিছনে আমার নাম লিখে অটোগ্রাফসহ একটা চিরকুটে দুটো সুন্দর গানের লাইন লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমি আশ্চর্য রকমের খুশি হয়েছিলাম।

এরপর শাফিন আহমেদের সাক্ষাতকার নিলাম। খুব স্টাইল করে চলতে পছন্দ করতাম। মাথায় হ্যাট পরতাম। চট্টগ্রাম বেতারে জানা অজানা ও জীবন্তিকা লিখে এবং দৈনিক পূর্বকোণে লেখা ছাপিয়ে যে টাকা পেতাম, সে টাকা লিপস্টিক ও নতুন নতুন হ্যাট কিনে খরচ করে ফেলতাম। শাফিন আহমেদ আমাকে হ্যাট পরা দেখে উচ্ছ্বাসে বললেন, “ওয়ান্ডারফুল ওয়ান্ডারফুল। মেয়েরা এভাবে স্টাইল করবে….. এভাবে দেখতেই ভালো লাগে।” এরপর সাক্ষাতকার নেয়ার পালা আইয়ুব বাচ্চুর। যার জন্য ঢাকায় আমাকে এক সপ্তাহ বেশি অবস্থান করতে হয়েছিলো। কারণ বাচ্চু ভাইয়ের শিডিউল পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই মানুষটা এতো বেশি সহজ সরল যে প্রথম ফোনালাপেই আমি তাঁর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লাম। ফোনে যখন হ্যালো বলতেন হার্টবিট বেড়ে যেতো আমার। এতো এট্রাকশন তাঁর কণ্ঠে! ফোনে বাচ্চু ভাইয়ের অসম্ভব স্মার্টলি হ্যালো বলার ধরণ শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়তাম। এদিকে আমাকে শিডিউল দিতে তাকে হিমশিম খেতে দেখেছি। আমাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছিলেন বাচ্চু ভাই। কারণ আমি ঢাকা গিয়েছি চট্টগ্রাম থেকে —- এটা তাঁর মাথায় ছিলো। তিনি চট্টগ্রামের ছেলে আর আমি জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের না হলেও স্থায়ী বাসিন্দা। সুতরাং এখানে একটু চট্টগ্রামপ্রীতি তো ছিলই।

সুরের এই গিটারের নাগাল পাচ্ছিলাম না। একদিন সন্ধ্যায় ফোনে আমার সাথে তাঁর স্ত্রী চন্দনাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানতে আমাকে সাহায্য করবে চন্দনা ভাবী। বাচ্চু ভাই বললেন, “চন্দনার সাথে কথা বলে ইন্টারভিউ’র আধেক সেরে ফেলতে পারবেন। বাকী আধেকের জন্য আমার মগবাজারের অফিসে চলে আসবেন।” সেদিনই বুঝেছি আইয়ুব বাচ্চু একজন অসাধারণ ব্যক্তি।খুবই সিম্পল তার মন মানসিকতা। তখন তাঁদের কোলজুড়ে ছিল কন্যা ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব বাবানী। নামটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কন্যার জন্য কত উচ্ছ্বাস সেটা দেখেছি তাঁর চোখেমুখে। পরে শুনলাম কন্যার ডাকনাম বাবানী চেঞ্জ করে অন্য নাম রাখা হয়েছে। আমি ভরদুপুরে মগবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। একটা কথা না বললেই নয়। এসব ক্ষেত্রে আমাকে খুব সহযোগিতা করেছেন আমার সেজোভাবীর মা। আমি মগবাজার যাবো সেজন্য ড্রাইভারসহ নিজের গাড়িটি আমাকে দিয়ে রেখেছিলেন। রাজ্যের জ্যাম ঠেলেঠুলে অবশেষে মগবাজার গেলাম। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হ্যালো স্মার্ট লেডি সম্বোধন করে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন বাচ্চু ভাই। মজার ব্যাপার হল আমাদের দুজনের মাথায়ই তখন হ্যাট। বাচ্চু ভাই সহাস্যে বললেন, “আপনিও আমার মত হ্যাট পরেন? আমেজিং। এই প্রথম বাংলাদেশে কোন হ্যাট পরা জার্নালিস্টকে দেখলাম। ভেরি নাইস টু সী ইউ।” আমি কথা হারিয়ে ফেললাম বাচ্চু ভাইকে চোখের সামনে এভাবে দেখে। তাঁর সবগুলো গান আমার মুখস্থ ছিলো। কথাটা বলতেই টেবিল চাপড়ে হেসে উঠলেন, “এমন সুন্দরী ফ্যান থাকলে হাজার হাজার গান গাইতে পারবো। কবরে যাওয়া অবধি গাইতে পারবো।” আমার পিলে চমকে উঠেছিল বাচ্চু ভাইয়ের মুখ থেকে ‘কবর’ শব্দটা শুনে। চিরন্তন সত্য কিন্তু ওই মুহূর্তে শুনতে একদম ভালো লাগেনি।

চা সিঙ্গাড়া চানাচুর শসা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সাক্ষাতকার পূর্ব সম্পন্ন করলাম। আমার দিকে একটা সাদা খাম এগিয়ে দিলেন। খামের ভেতর তাঁর দুটি ছবি। সাক্ষাতকারের সাথে ম্যাগাজিনে ছাপানোর জন্য। এই বিরল গুণটি দেখে আমি আরও মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। আমার মুখভঙ্গি দেখে বাচ্চু ভাই সেই জটও খুলে দিলেন। “শোনেন মিলি ম্যাডাম, বাচ্চুর ইন্টারভিউ নেয়ার সময় জার্নালিস্টদের সাথে ফটোগ্রাফার নিয়ে আসতে হয়। ছবি তুলে নিয়ে যেতে হয়। ফটোগ্রাফার ছাড়া ইন্টারভিউ আমি এলাউ করিনা। এইকথা শুনে আমি সরি হলাম। বললাম, বাচ্চু ভাই মিজান ভাই ফটোগ্রাফার পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি উনাকে বলেছি লাগবেনা ফটোগ্রাফার। ছবি আমি নিয়ে আসবো। আমার কথা শেষ না হতেই বাচ্চু ভাই গান গাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বললেন, কেন এই কথা বললেন? এতো কনফিডেন্স কেন জানতে পারি? আমি জবাব দিলাম, তা জানিনা। তবে আমার মনে হয়েছিলো আমি আপনার অফিসে আসবো, আপনার ছবি নিয়ে যাবো। চমৎকারভাবে শব্দ করে হাসলেন বাচ্চু ভাই, “মিলি ম্যাডাম এমন কনফিডেন্স খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। আপনি আমার মন জয় করে ফেলেছেন। আমার বউও আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে পছন্দ করেছে। থাকুন আমাদের সাথে। আপনি লিখতে থাকবেন। আমি সেগুলোকে সুরে বাঁধবো।” বাচ্চু আগ বাড়িয়ে আসলে মানুষটা অসম্ভব জিনিয়াস। অসাধারণ অবজারভেশন তাঁর। নিজের বুকে আঙ্গুল দিয়ে গুঁতো মেরে বললেন, বাচ্চু আগ বাড়িয়ে কাউকে ছবি দেয়না। আপনাকে দিয়েছে। একটা কানেকশন আছে। জানেন কি সেটা? আমি দেরী না করে বলে ফেললাম, ‘চট্টগ্রাম কানেকশন।’ সাংঘাতিক খুশি হলেন বাচ্চু ভাই। এটা সত্যি চট্টগ্রামপ্রীতি খুব গুরুত্ব পেয়েছিল। আলাপচারিতার ফাঁকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কয়েকটা বাক্য বললেন। আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। এতটুকু অহংকার নেই তাঁর মধ্যে। মনখুলে হাসেন, কথা বলেন। অফিসে তাঁর এক সহকারী ছিলো। ড্রয়ার খুলে ক্যামেরা বের করে তাকে বললেন, দুই “হ্যাটবাজের” ছবি তুলে দিতে। “হ্যাটবাজ” শব্দটা আমার পছন্দ হল। কারণ আমরা দুজনই হ্যাটবাজ অর্থাৎ মাথায় হ্যাট পরা। কালো হ্যাট। বাচ্চু ভাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবিতে পোজ দিলাম।

পরেরবার ঢাকা গেলে তাঁর সাথে তোলা সেই ছবি আমাকে দেবেন বলে দিলেন। কিন্তু আমার বহুদিন আর ঢাকা যাওয়া হয়নি। সেই ছবিও আর নিজের চোখে দেখতে পাইনি। হয়তো বাচ্চু ভাইয়ের ড্রয়ারে অনেকদিন পড়েছিলো। তারপর কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে তাঁর সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তিনিও দিন মাস বছর ব্যস্ত ছিলেন সৃষ্টির উল্লাসে। দ্যা লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু আজ আমার কাছে কেবলি যন্ত্রণাময় এক স্মৃতির নাম। এখনও অনেক রাত হয়। খোলা আকাশের নিচে না হলেও দেয়ালঘেরা খাঁচায় রাত জেগে আমি স্মৃতিতে তলিয়ে যাই। চোখের পাতা জলে ভরে যায়।

-এসএম

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter