আত্মহত্যা কখন কারা করে!

আত্মহত্যা কখন কারা করে!

সুমি ইসলাম:

সুইসাইড বা আত্মহত্যা:
সুইসাইড বা আত্মহত্যা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি আর কি লিখব? আর যা হয়ত লিখব তাও খুবই সাধারণ। কারো ভালো লাগবে কারো ভালো লাগবেনা ।

তারপরও ইচ্ছা হলো এই জঘন্য ঘৃণিত বিষয়টা নিয়ে লেখার জন্য,

বাংলাদেশে অনেক নারী-পুরুষ বিশেষত মেয়েরা জীবন সংগ্রামের পরিবর্তে জীবন থেকে পালিয়ে যাবার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। তুচ্ছ পারিবারিক কলহ, বিদ্যালয়ে যাবার পথে বখাটেদের উৎপাত, ভালোবাসায় ব্যর্থতা ও প্রতারণা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তরুণীরা এবং স্বামীর নির্যাতন-অত্যাচার, যৌতুক সমস্যা, স্বামীর অর্থনৈতিক অক্ষমতা, পারিবারিক অশান্তি থেকে বাঁচার পথ হিসেবে অনেক মহিলা আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছে। এসবই বড় ভুল, এসব সমস্যা সব দেশে, সব জাতিতে আছে। আত্মহত্যা এসবের কোনো সুষ্ঠ সমাধান বা সঠিক প্রতিকার নয়।
আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। নিজেকে নিজেই হত্যা করা। এটা হলো অস্বাভাবিক চিন্তার জগতের থেকে সম্পাদিত ক্রিয়া। সুইসাইডের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিখ্যাত লোকদের মধ্যেও আছে। কিংবদন্তীর মধ্যে আছে, আছে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। বিবাহিত-অবিবাহিত, প্রেমিক-প্রেমিকা, চোর-সাধুরাই নন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এ অভিশপ্ত পথ বেছে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ক্লিওপেট্রা, নিরো, এডলফ হিটলার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ক্রিস বেনওয়েট, ভিনসেন্ট ভ্যন গফ, দিব্যা ভারতী, সালমান শাহ এবং ষাট দশকের গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়া সুন্দরী অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো’র নাম উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানীসহ নানা অভিজাত শ্রেণির মানুষও সুইসাইড করেছেন এবং করছেন ।

প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ।কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ।

আমেরিকায় প্রতি বছর গড়ে ৪৫ হাজারের অধিক মানুষ সুইসাইড বা আত্মহত্যা করে। জাপানে প্রবীণদের মাঝে আত্মহত্যার মাত্রা বেশি দেখা যায়। আত্মহত্যা সবচেয়ে বেশি করে হতাশাগ্রস্থ তরুণ তরুণীরা। বয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবনতা দেখা যায়। উন্নত দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা শীতকালে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে অধিক দেখা যায়। ধনী দেশগুলোর চেয়ে গরিব দেশের মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে। তবে রাশিয়াতে প্রচুর ধনী লোকজন আত্মহত্যা করে থাকেন।

আত্মহত্যা কখন কারা করে এবং বাংলাদেশে আত্মহত্যার চিত্র :

বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিবছর অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। তবে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ডাটা নেই, কিন্তু দেখা যায় যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলো খুব স্পষ্ট এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই একই ধারনের । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণ তরুণীরা আত্নহত্যা নামাক ঘৃণিত কাজটা বেশী করে থাকে। তাছাড়া মানসিক রোগী, মাদকাসক্ত, সামাজিক পারিবারিক, দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীতরাই বেশি আত্মহত্যা করে থাকে। এছাড়া পরীক্ষায় আশানুরুপ ফল না পেয়ে, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে, ঋণগ্রস্থ হয়ে , অপমানিত-অপদস্থ , ধর্ষণের শিকার হয়ে, প্রেমে ব্যর্থতা,চাকরী না পেয়ে, সংসারে বনিবনা হলে, স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়ার কারনেও অনেকে এই পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেক সময় দারিদ্রতার জন্যে স্বপরিবারে আত্মহত্যার খবরও পত্রিকায় দেখা যায়। তবে এ ব্যপারে নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই, কারা কেনো আত্মহত্যার মত ঘৃণিত, ভয়ানক ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিচ্ছে।

আত্মহত্যা নারীদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে বেশি দেখা যায় । ১৫ থেকে ২৫ বছরের ছেলে মেয়েদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো আত্মহত্যা। আমাদের দেশে তরুণী বা নারীরা পুরুষদের তুলনায় আত্মহত্যার প্রচেষ্টা একাধিকবার চালায় এবং তারা সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পয়জনিং জাতীয় দ্রব্যাদির খেয়ে বা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে থাকে। কিন্তু এব্যাপারে পুরুষরা অধিকতর বিপজ্জনক পদ্ধতি বেছে নেন আত্মহত্যার জন্যে, যেমন পিস্তল শুটিং, উপর থেকে ঝাঁপ দেয়া, ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পরা। নারীরা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, যা পুরুষদের বেলায় খুব একটা দেখা যায় না। তাদের এই একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টাকে অনেকে আবার ‘তার প্রতি বা তার চাওয়া পাওয়ার দৃষ্টি নিবন্ধন করার চেষ্টা’ (এটেনশন সিকিং) বলে মনে করেন, যা সম্পূর্ণ ভুল।
কেউ যদি বলে, আমি চলে যাবো, আমি কিন্তু মরে যাবো, আমাকে আর পাবে না বা আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছা করে না, তবে সেটা অবশ্যই অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তাকে সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং নিতেই হবে। কারণ যারা আত্মহত্যা করেছে তারা এ ধরনের কথা প্রায়শ বলেছে।

প্রত্যেকটি আত্মহত্যা সেই পরিবারের জন্যে বেদনাদায়ক। প্রতিটি আত্মহত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে । এটা এমন না যে গায়েবি কেউ বললো আর ওমনি সে আত্মহত্যা নামক ঘৃণিত পথে পা বাড়াবে। তবে মানসিক ভারসাম্যহীন বা মাদকাসক্তদের কথা আলাদা। অনেক সময় তাদের হেলুসিনেসন হয়, তারা শুনতে পায় কেউ তাদের কমান্ড করছে, নিজেকে মেরে ফেলো। ফলে তারা আত্মহত্যা বা হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়।
আত্মহত্যার জন্যে কাউকে দায়ী করতে হলে প্রথমে যে বা যিনি আত্মহত্যা করেছেন তাকেই আমরা দায়ী করি। তারপর পারিপার্শ্বিক বিষয় বিবেচনায় আনি। কারণ প্রতিটি মানুষের জীবন তার নিজের কাছেই আগে গুরুত্বপূর্ণ।

আত্মহত্যাকারীদের আত্মহত্যার ব্যাখ্যা এবং আত্মহত্যা থেকে কিভাবে মুক্ত থাকা যায়?

বিশ্বের সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্টরা আত্মহত্যা নিয়ে অনুসন্ধান করতে আত্মহত্যাকারীদের বেশ কিছু ‘সুসাইডাল নোট’ বা আত্মহত্যাকারীর স্বহস্তে লিখে যাওয়া কিছু ‘চিরকুট’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। সবক্ষেত্রেই চিরকুটগুলোর সারমর্ম মোটামুটি এক। আর তা হলো- আত্মহত্যাকারী নিজেকে এখন সমাজ ও পরিবারের বোঝা মনে করছে বা সে তীব্র যন্ত্রণায় দিনযাপন করছে যা থেকে মুক্তি নেই, অথবা তার জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনায় এখন তার কাছে মনে হচ্ছে মৃত্যুই মুক্তি অথবা মৃত্যুই এখন একমাত্র সমাধান।
অনেক সময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভেবে বা নিজেকে পরিবারের বোঝা ভেবে আত্মহননের পথ বেছে নেন। ঘোরতর মানসিক রোগীর কথা একটু ভিন্ন। রোগ হিসেবে বলতে গেলে বলতে হয়, আত্মহত্যার প্রধান কারণ হলো ডিপ্রেশন।

প্রতি তিনজন ডিপ্রেশন রোগীর মধ্যে দুইজনকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। অনেকে মনে করেন সাময়িক কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আত্মহত্যা করে, বিষয়টি আসলে ঠিক সে রকম না। তাহলে তো পৃথিবীর সবাই আত্মহত্যা করতো। মূলত আত্মহত্যাকারী নিজেকে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হয় যে তার বেঁচে থাকার আদৌ কোন মানে আছে। এতা তার থিংকিং প্রসেসের ভুল।

তবে আত্মহত্যাকারীর মধ্যে এসব সহসাই দেখা দেয় যে তা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এর কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন তারা সম্প্রতি কোন ক্রাইসিসে পড়েছেন, নিকট কারো মৃত্যু হয়েছে, স্বজনহারা হয়েছেন।
এছাড়া প্রেমের সম্পর্ক নষ্ট হওয়া, ডিভোর্স হওয়া, চাকুরিচ্যুত হওয়া, দুরারোগ্য বা জটিল কোনও রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া, অপমান অপদস্থ হওয়া, শারীরিক লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হওয়া, ধর্ষিত হওয়া, প্রতারিত হওয়া, মারাত্মকভাবে যে কোনো ব্যাপারে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি প্রায় সময় থাকেই। আর এসব কারণে নিজেই নিজের প্রতি ক্রমশ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। বেঁচে থাকার পক্ষে তখন কোন যুক্তিই তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়না।

অনেক সময় কিছু কিছু আত্মহত্যাকারীদের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তার মধ্যে নানান এন্টসোশ্যাল পার্সোনালিটি বৈশিষ্ট্য থাকে যেমন চুরি করা, মিথ্যা বলা, ঠকানো, ঋণখেলাপী হওয়া বা কাউকে হত্যা করা। আত্মহত্যা কারীদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অতীতে আত্মহত্যার ঘটনার প্রমান পাওয়া যায়।

একমাত্র সচেতনতাই পারে প্রিয়জনের আত্মহত্যা রোধ করতে। তার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে। তাকে সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং এর জন্যে সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হই। “মুখপোড়া, বংশের কলংক, তোর এমন কাণ্ড-কীর্তি আর পরিণাম দেখার আগে কেনো আমাদের মরণ হলো না” এ রকম কোন কথা বলে একান্ত প্রিয় মানুষটির আত্মহত্যার পরিকল্পনাকে আরো ত্বরান্বিত না করে বরং তার দিকে ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়াই। কোন সমস্যা হলে তার পাশে থাকা তাকে আরো বেশী সাহস যোগানো উচিত। আমরা মানুষ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে আমরা কেন আত্মহত্যা করব? আমরা নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। তাহলে আমরা কেন অবিবেচকদের মতো নিজেদের জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছি। কেনইবা আমরা আত্মহত্যাকে সব সমস্যার সমাধান হিসেবে নিচ্ছি। এটাই সবাই কে বুঝতে হবে । হেরে গেলে চলবেনা। ঘুরে দাঁড়াতে হবে , নিজেকে ভালোবাসতে হবে , অন্যকে ভালো রাখতে হবে এবং আত্মহত্যার মতো মহাপাপকে ‘না’ বলতে হবে।

-শিশির

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter