‘উবুনটু’ করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন

উবুনটু করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন

অনলাইনঃ

চমকপ্রদ এক ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক, এক নৃতত্ববিদ আফ্রিকার প্রত্যন্ত অন্চলে কাজ করছিলেন একটি উপজাতির মানুষের বৈশিষ্ট নিয়ে। উপজাতীয় কিছু শিশু কাজের সময় প্রায়ই তাকে ঘিরে থাকতো, আর তাদের জন্য তিনি সবসময়ই বেশ কিছু ফল বা চকলেট সাথে রাখতেন। একদিন দিনশেষে যখন তাকে ফিরিয়ে নেবার গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন মনে হল এই শিশুদের সাথে মজার কিছু একটা করা যাক।

তিনি তার সাথে থাকা ফলগুলো একটা গাছের নীচে এক ঝুড়িঁতে রাখলেন আর শিশুদেরকে একটু দূরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে বললেন, আমি স্টার্ট বলার সাথে সাথেই তোমরা দৌড় দিবে, আর যে প্রথম হবে, সবগুলো ফলই তার। তিনি স্টার্ট বলতেই অবাক হয়ে দেখলেন, দৌড়ানোর পরিবর্তে ওরা সবাই আগে হাত ধরলো এবং একসাথে ঐ ঝুড়ির কাছে পৌছে ফলগুলো নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিল।

তিনি বিস্মিত হয়ে, ওরা এমন কেন করল প্রশ্ন করতে, ছোট একটি মেয়ে উত্তর দিল, ‘আমাদের মাঝে একজন কেমন করে আনন্দ পাবে, যখন সবার মন খারাপ থাকবে?’

নৃতত্ববিদ অবাক বিস্ময়ে বসে পড়লেন আর ভাবলেন, বেশ কিছুদিন কাজ করে বোধকরি আজ তিনি এই উপজাতীয় মানুষের প্রকৃত চরিত্রের খোঁজ পেলেন।

উবুনটু প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাংশের একটা দার্শনিক চিন্তা, যা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই দিক নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার হবার প্রমান পাওয়া গেলেও বিংশ শতকের মাঝামাঝি শব্দটির আন্তর্জাতিকীকরন হয়।

উবুনটু করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন
উবুনটু করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন

গত শতাব্দীর ষাট সত্তরের দশকে আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতার সময়েও দর্শনটি ব্যবহৃত হয়েছে, নব্বই এর দশকে দক্ষিন আফ্রিকায় বর্নবাদী শাসনের শেষে বিশপ ডেসমন্ড টুটুকে প্রধান করে যে Truth and reconciliation কমিশন করা হয়েছিল, সেটাও এই দর্শনকে মাথায় রেখে কাজ করেছে।

বান্টু ভাষায় উবুনটু অর্থ মানবিকতা। আর ‘I am because We are ‘ অথবা‘ আমি অর্থাৎ আমরাই‘ এই দর্শনের মূল কথা। ‘আমি’ বা আমিত্ব কে বাদ দিয়ে ‘আমরা সবাই’, এটাই উবুনটু বোঝাতে চায়।

দক্ষিন আফ্রিকায় জুলু উপজাতিরা উবুনটু উচ্চারণ করলেও, সীমান্তবর্তী জিম্বাবুয়েতে সবচে বেশী ব্যবহৃত সোনা ভাষায় এটা উনহু, আবার মালাউয়িতে এটা উমুনথু। তবে যে দেশে বা যে ভাষায়ই বলা হোক না কেন, এই দর্শনের মূল সুর একইরকম।

এই দর্শনে একজন পিতামাতাহীন শিশু কখনো এতিম বলে গন্য হবে না, অচেনা স্থানে একজন পরিব্রাজকের থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা করতে হবে না। আবার কেউ কোন অপরাধ করলে, সেটা শুধু তারই অপরাধ নয়, সে কোন পরিবার বা সমাজ থেকে এসেছে, এই অপরাধের দায় কিছুটা তাদেরও, সুতরাং সবাই মিলেই এই অপরাধ ভবিষ্যতে না করবার শপথ করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০৬ সালে, ব্রিটিশ লেবার পার্টির সম্মেলনে এই দর্শনের কথা বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উবুনটু দর্শনকে বলেছিলেন বিশ্বের জন্য আফ্রিকা তথা নেলসন ম্যান্ডেলার উপহার।

অন্ধকার মহাদেশ হিসেবে, তথাকথিত সভ্য মানুষেরা আফ্রিকা মহাদেশকে বর্ননা করলেও, এমন অনন্য এক দর্শনের আলো আফ্রিকাই বিশ্বকে দিয়েছে।

 ‘উবুনটু’ করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন
উবুনটু করোনাদিনে বিশ্বের জন্য আফ্রিকান দর্শন

আমাদের দেশেও যদি এই দর্শন আমরা প্রচলন, প্রয়োগ ও চর্চা করতে পারি, তাহলে এমনকি এই মহামারীর দিনেও গরীবের ১০ টাকার চাল চুরি করতে একজন দুবার ভাববে, দূর্নীতির মহোৎসব কমবে, এবং এভাবেই হয়ত একদিন সহনশীল, প্রতিনিধিত্বমূলক গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

আর এই করোনা দিনে আর করোনা উত্তর অন্যরকম পৃথিবীর জন্য উবুনটু দর্শনের প্রয়োজন আরো বেশী সবার জন্য, সারা বিশ্ব জুড়ে।করোনা মহামারীর মত পুরো বিশ্ব জুড়ে এতবড় মানবিক বিপর্যয়, মানুষের জ্ঞাত ইতিহাসে কখনো ঘটেনি, আর এর শেষ কোথায় এটাও কারও জানা নেই। সুতরাং করোনা উত্তর পৃথিবী সম্ভবত হতে যাচ্ছে সম্পূর্ন অন্য এক জগত, যা আমাদের ধারনার বাইরে ।

সেই জগতে মানুষে মানুষে ভালবাসা, সৌহার্দবোধ আর সকলের তরে সকলে আমরা মানসিকতাই বাচিয়ে রাখবে, আর এগিয়ে নিবে মানবসভ্যতাকে।

আসুন সেই আফ্রিকান উপজাতীয় শিশুদের মত করে আমাদের সন্তানদেরও একই ঐকতানে বড় হতে শেখাই ।

ওদের শেখাই, দৌড়ে প্রথম হওয়াই জয় নয়, সবাই মিলে একসাথে শেষ ধাপে পৌঁছানোই আসল জয়।

/সোহেল খোন্দকারের ফেসবুক থেকে

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter