গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডিতে এডিস লার্ভা বেশি

অনলাইনঃ

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় আরো ১ হাজার ৯৬ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে।

সরকারি তথ্য মতে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬৩৭ জন আক্রান্ত এবং আটজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আরো বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর মধ্যেই ডেঙ্গুজ্বর দেশের ৫০ জেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে।

সরকারি হিসাবের বাইরে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই ডেঙ্গুতে। আর এ পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একটি পত্রিকার জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নানান তৎপরতা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে রাজধানীতে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রকোপ সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে। চলতি মাসে ১০ দিন ধরে ওই শাখার কর্মকর্তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জরিপ পরিচালনা করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ঢাকা উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু উত্তরের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে অভিজাত এলাকা। ঢাকা দক্ষিণের ৭৮ শতাংশ এলাকায় এবং ঢাকা উত্তরের ৫৮ শতাংশ এলাকায় অতিমাত্রায় ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যায় ওই জরিপে।

এ চিত্র থেকে বলা যায়, রাজধানীর ঘরে ঘরে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার লার্ভা ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বত্রই মিলছে এডিস লার্ভা। পুরো রাজধানীর বাসিন্দারাই এখন ডেঙ্গু জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে।

জরিপ মতে, ঢাকা উত্তর সিটির অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এবং দক্ষিণের ধানমণ্ডি, গেণ্ডারিয়া, স্বামীবাগ, মায়াকানন ও সবুজ কানন এলাকায় এডিস লার্ভার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।

১৮ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটির ৯৮ ওয়ার্ডের একশ’ স্পটে এ জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৯ এবং উত্তর সিটির ৪১ এলাকায় সংক্রামণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত কয়েকটি দল ভাগ হয়ে এই জরিপ কাজ পরিচালনা করে। এই জরিপের ফলাফল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

জরিপ কাজের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা উত্তর সিটির গুলশান ও বনানী এলাকায় এডিস মশার লার্ভার মাত্রা ২৫০-এর মতো পাওয়া গেছে। উত্তর সিটির মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এছাড়া দক্ষিণ সিটির স্বামীবাগ এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই এলাকায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি ৯০ মাত্রায় পাওয়া গেছে। মায়াকানন ও সবুজ কানন আবাসিক এলাকায় ৮০ মাত্রায় লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। লার্ভার মাত্রা ২০-এর বেশি হলে সেটিই ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা :

১ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরা এলাকা, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের গাবতলী, মিরপুর কলোনি ও দারুসসালাম এলাকা, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়া, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভাসানটেক, মাটিকাটা, মানিকদী ও বারেনটেক, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের গুলশান ও বনানী, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও বি জোন, পূর্ব হাজীপাড়া ও চৌধুরীপাড়া, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও কুনিপাড়া, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের লালমাটিয়া, আসাদগেট, খিলজী রোড, বাবর রোড, ইকবাল রোড, আওরঙ্গজেব রোড ও পিসি কালচার এলাকায় এডিস লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া পাওয়া গেছে এবং এসব এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা :

১ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও এ ও সি জোনের খিলগাঁও কলোনি এলাকা, মায়াকানন, সবুজবাগ, উত্তর মুগদাপাড়া, আহম্মেদবাগ, কদমতলা ও বাসাবো, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের মালিবাগ, বকশী বাগ, গুলবাগ, শান্তিবাগ ও ইন্দ্রপুরী, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের চামেলীবাগ ও আমিনবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পুরানা পল্টন, বিজয় নগর, সিঅ্যান্ডবি মাঠ ও শান্তিনগর বাজার এলাকা, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কেএম দাস লেন, অভয়দাস লেন, টয়েনবি সার্কুলার রোড, জয়কালী মন্দির রোড, ভগবতী ব্যানার্জী রোড, ফোল্ডার স্ট্রিট, হাটখোলা রোড ও আর কে মিশন রোড, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের দয়াগঞ্জ রোড, দয়াগঞ্জ হাটলেন, দয়াগঞ্জ জেলেপাড়া, নারিন্দা লেন, শরৎগুপ্ত রোড, বসু বাজার লেন ও মুনির হোসেন শাহ লেন।

এছাড়াও ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের ডিস্ট্রিলারি রোড, দীননাথ সেন রোড, ক্যাশাব ব্যানার্জী রোড, শশীভূষণ চ্যাটার্জী লেন, রজনী চৌধুরী রোড, সাবেক সরাফৎ গঞ্জ লেন ও সত্যেন্দ্র কুমার দাস রোড, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের মিল ব্যারাক অ্যান্ড পুলিশ লাইন, ক্যাশাব ব্যানার্জী রোড, অক্ষয় দাস লেন, শাঁখারী নগর লেন, হরিচরণ রায় রোড, আলমগঞ্জ রোড, ঢালকানগর লেন ও সতীশ সরকার রোড, ৪৮ ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

এই জরিপের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ডা. আক্তারুজ্জামান জানান, জরিপকাজ শেষ হলেও চূড়ান্ত ফল এখনো হাতে আসেনি। সার্বিক বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হলে জরিপের ফল সবাইকে জানানো হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জরিপে যা দেখা গেছে, সে অনুযায়ী গুলশান ও বনানী এলাকায় এডিস মশার লার্ভার বেশি উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্য অনেক এলাকায় কমবেশি লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধু অভিজাত এলাকা নয়, এর বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় লার্ভার উপস্থিতি মিলেছে। তবে নির্মাণাধীন ভবন, ডাবের খোসা, টায়ার, পানি জমে থাকা বিভিন্ন পাত্রের মধ্যে অধিকমাত্রায় লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মশার প্রজনন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ওই জরিপ চালানো হয়েছে। ১০ দিনব্যাপী জরিপকাজ শেষ হলেও ফল যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। ফল চূড়ান্ত হলে তা প্রকাশ করে পরিস্থিতি সবাইকে জানানো হবে।’

মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘মশা নিধন করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ নয়। আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করাই আমাদের মূল কাজ। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগী নিয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং সে অনুযায়ী রোগ প্রতিরোধে গাইডলাইন নির্ধারণ করে সংশ্নিষ্টদের তা অবহিত করাই স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ। যাতে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজটি করতে পারে। এরই অংশ হিসেবে ওই জরিপ চালানো হয়েছে।’

এদিকে ২২ জুলাই থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে মাঠে নেমেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ২৪ জুলাই ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ারের নেতৃত্বে ১৫৪ ভবনে অভিযান চালিয়ে এডিসের লার্ভা পাওয়ায় ২২ ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়। ২৫ জুলাই ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৯ ভবন মালিককে জরিমানা করেন। দুই সিটি করপোরেশন গত ছয় দিনে ২৪৩ ভবনে অভিযান চালিয়ে ৩৯ ভবন মালিককে জরিমানা করে।

-কেএম

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter