জীবন…ঝরা বকুলের এক আকাশ কান্না

মিলি সুলতানা, কুইন্স, নিউইয়র্ক থেকেঃ

ছোটকালে খেলার সাথীরা দুষ্টুমির ছলে বলতো, “তুই বিলাই সাদা”……সত্য কথা বলি, বিলাই সাদা হয়ে আমি খুশি নই। কেমন যেন বৈষম্য বৈষম্য গন্ধ পাই। বাচ্চাদের স্কুলের প্যারেন্ট কনফারেন্সে গেলেও একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। ওদের ক্লাসমেটরা ভাবতো বাবা বাংলাদেশী মা বিদেশী কিনা! এমন অভিজ্ঞতা আমার ছেলের বেশী হয়েছে। সতেরো সালের নভেম্বরে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওর চশমার অর্ডার দিতে। ডাক্তার চশমার পাওয়ার চেক করে দেয়ার পর ছেলের মুখ দেখে বুঝলাম ওর ক্ষিধে পেয়েছে। বাসস্ট্যান্ডের সাথেই ছিল জায়রো দোকান। জায়রো হল আফগানি ফুড। চিকেন সালাদ দিয়ে মোড়ানো বিশেষ রুটি। এছাড়া চিকেন ওভার রাইস, ল্যাম্ব ওভার রাইস,কাবাব এবং ফালাফাল ওভার রাইস। জায়রো দোকানদার খুবই মিষ্টভাষী, বিনয়ী। আমার ছেলের সাথে অল্পক্ষণের মধ্যে তার ভাব হয়ে গেলো। তার ছোটভাই আমার ছেলের মতো কলেজে পড়ে, সেকেন্ড ইয়ারে। আমি পেমেন্ট করে অদুরেই বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। বেঞ্চে আরও তিনজন সিনিয়র সিটিজেন ছিলো। একজন নিকারাগুয়ার, অন্য দুজন বলিভিয়া এবং আল সালভেদরের। সম্পূর্ণ অপরিচিত তিন সিনিয়র সিটিজেন মাত্র কয়েক মিনিটের পরিচয়ে গভীর আলাপে ডুবে গেলো। বাস আসতে তখনও চল্লিশ মিনিটের মত সময় ছিল। ‘হ্যালো’ বলে মুচকি হেসে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়লাম বেঞ্চের শেষ মাথায়। তাঁরা নিজেদের আরাম করে বসার ধরণ বিসর্জন দিয়ে আমাকে আরেকটু জায়গা ছেড়ে দিলো। আমি সাথে সাথে “না না আমি ঠিক আছি ঠিক আছি। এটাই এনাফ” বললাম। কিন্তু ওরা আমার কথা আমল দিলো না। তাঁদের চোখেমুখে উজ্জ্বল আভা। চেহারায় বেদনার লেশ নাই। কত সুখী অভিব্যক্তি। এই তিনজনই বৃদ্ধ বয়সে সুখে আছে। নিজের বাড়িতে থাকে। প্রতিমাসে সরকার থেকে মোটা অংকের সিনিয়র ভাতা পায়। তাঁদের কোন ট্যাক্স কাটে না। চিকিৎসা ফ্রি। বাস ট্রেনে অর্ধেক ভাড়ায় চলাফেরা করতে পারে। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশের সিনিয়র ব্যক্তিরা কত কষ্টে আছে। ছেলের বউয়ের রোষানলে পড়ে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হতে হচ্ছে।

এরইমধ্যে বাস চলে এলো। জায়রোর প্যাকেট হাতে নিয়ে ছেলে আমার পাশে বসে অকারণে হাসলো। অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলার আগের সিগন্যাল এটা। বললাম, ‘জায়রোর বেটা একই প্যাচাল পেড়েছে, তাইনা?’ ছেলে গা নাড়িয়ে হাসলো, ‘Did you guess what? Oh my goodness…. How come? You know I’m telling that you’re genius……!’ বেটা ভেবেছে ওর বাপ পাকিস্তানি মা হয়ত স্প্যানিশ। ওর চেহারায় কিছু অংশে নাকি আমার সাথে মিল পেয়েছে। যে অংশে মিল পায়নি, তা হয়ত বাপের অংশ।

ট্রাম্পের সময়ের শুরুতে গোটা আমেরিকা জুড়ে খুব বর্ণ বৈষম্য দেখা দিয়েছিলো। হিজাব পরার কারণে অনেককে হেইট ক্রাইমের শিকার হতে হয়েছে।আমার স্প্যানিশ বন্ধু এলিয়ানা ওই ক্রাইসিস মুহূর্তে মজা করতে ছাড়েনি, ‘মিলি রেসিজমের প্রশ্নে তুমি বেনিফিশিয়ারি হবে, আনডাউটলি। তুমি বাঙ্গাডেশী (এলিয়ানার উচ্চারণে) হয়েও হোয়াইটদের সমগোত্রীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুর উক্তি শুনে খুব আহত হয়েছি। গত পরশুদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে জ্যাকেট পরা অবস্থাতেও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। মেয়ে বলল, সামারে তুমি রোদে যাবা আর লং টাইম থাকবা। আমি বললাম, কেন? সে বলল, তুমি বেশি হোয়াইট। সান বাথ নিয়ে ডার্ক কালার করবা গায়ের রঙ। আমি মরি শীতের জ্বালায়, মেয়ে আছে আজাইরা আলাপে…..হালকা বকা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলাম। ক্রিমিনাল কোর্টে জুরি ডিউটি করতে গিয়েও বেশী সুখকর অভিজ্ঞতা হয়নি। রেজিস্ট্রেশন বইতে নাম লেখানোর সময় কোর্টে কর্মরত আমার মত উচ্চতার এক মহিলা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো। আমি বাক্যগুলোর কিছুই বুঝলাম না। ইংরেজি ব্যবহার করা ছাড়া আমার কোন গতি নাই। মহিলাকে বললাম, তুমি যদি এই কথাগুলো ইংলিশে বলো আমি খুব উপকৃত হবো। মহিলা বিব্রত, লজ্জায় মুখ তার লাল টমেটোর মত দেখাচ্ছিল। সরি বলল চার পাঁচবার। তার খুবই অনুচিত হয়েছে স্প্যানিশ ল্যাংগুয়েজে কথা বলা। এটা কোনভাবেই উচিত হয়নি…..বার বার এটা বলছিলো। সে দুম করে ধরে নিয়েছে আমি তার জাতি বোন। মহিলাকে এতবার সরি হতে দেখে আমিই গিল্টি ফিল করলাম। কখনো ভাবি যদি শাড়ি সালোয়ার কামিজ পরে সব জায়গায় যেতে পারতাম। তাহলে এমন প্রশ্নের সামনে পড়তাম না। কিন্তু নিয়মের বেড়িতে বাঁধা পড়ে গেছি। যে দেশের যে বেশ, চলতে হয় সেভাবে।

-এসএম

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter