পোশাকের দৈর্ঘ্য বনাম নারী জীবনের ম্যারাথন দৌড়

মনিরা সুলতানা পাপড়িঃ

পুরুষতন্ত্র একটা আইডিয়োলজি। সেটার ভিক্টিম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। একটা আইডিয়োলজি একটা মন্সটারাস কোম্পানির মতো, কেউ না থাকলেও সিস্টেম এটাকে বেশ অনেক দিন চালিয়ে নিয়ে যায়। সেটার ফ্ল্যাগ বিয়ারার যে কেউ হতে পারে।

আমরা লেখাপড়া তো করেছি, কিছু সার্টিফিকেট নিয়েছি। কিন্তু আমাদের স্বশিক্ষা হয়নি। তাই বই এবং সমাজের ফিক্সড করে দেয়া সেই আইডিয়োলজিকে ঘাঁটতে শিখিনি। কারণ সমাজ আমাদেরকে ভালো মেয়ে হবার মূলা ঝুলিয়ে রেখেছে। আমরা সেই মূলার পেছনে ছুটছি। তথাকথিত ভালো মেয়েরা উচু গলায় বিতন্ডা করেনা,প্রশ্ন করেনা, প্রথার বাইরে যায় না,হিসেব বুঝে নেয় না। এতে যেন কার সুবিধে? সেই তন্ত্রের।
ভালো মেয়ে সাজবার চক্করে আমাদের মেয়েরা মানুষ হয়েই উঠতে জানলোনা। এটাই দুঃখ। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। এই বলে তো শেষ করলো, হরিণকে আর লড়তে দিলো না। হরিণ এখন শুধু পালানোই শিখেছে। অথচ সাপের মুখে পড়া ব্যাঙ ও পেট ফুলিয়ে ফুলিয়ে সাপের মুখ রক্তাক্ত করে,ঘন্টার পর ঘন্টা লড়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসে। প্রমান করে সে ফিটেস্ট।

সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট। কিন্তু সেই হরিণ কে বা আমাদের মেয়েদেরকে সেই লড়বার মন্ত্রটাই তো নিতে দিচ্ছেনা। পোশাকের দোহাই দিয়ে,চেহারার দোহাই দিয়ে,লোকে কি বলবে দোহাই দিয়ে আটকে রেখেছে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরীই বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।

বাঙালী সংস্কৃতি তবে শুধু মেয়েদের জন্য কেন? প্যান্টালুন বা প্যান্ট তো বাংগালী সংস্কৃতি নয়।
বাঙালী ভাত-মাছ খায়, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে, জারি-সারি-ভাটিয়ালি শোনে, এগুলো বাঙালী সংস্কৃতির উপাদান। এ রকম সহস্রাধিক উপাদান রয়েছে, যেগুলো বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করে। তাহলে ছেলেরা শুধু লুংগী,পাঞ্জাবী পরবে। প্যান্ট, স্যুট কেন?

সংস্কৃতি শুধু পোশাকে কেন, খাবারে কেন নয়, গানে নাচে কেন নয়,প্রযুক্তির ব্যবহারে কেন নয়?
আমরা কয়টা শাড়ি তাঁতের কিনি?, কয়টা বাংলাদেশী প্রসাধনী ব্যবহার করি?? এই যে সালোয়ার কামিজ পরি এটা তো বাংলা সংস্কৃতি নয়, এটা পাকিস্তানি সংস্কৃতি। বাংলা সংস্কৃতি অনুযায়ী শাড়ি হচ্ছে আমাদের পোশাক। কিন্তু শাড়ি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম আবেদনময়ী পোশাক। শাড়ি পরলে একটা মেয়ের শরীর যেভাবে উন্মুক্ত হয়, অন্য পোশাকে হয় না।
৭০ এর দশকে নভেরা ম্যাম, বিবি রাসেল,রুনা লায়লা রা কি বাংলা সংস্কৃতির বাইরে?

১৯৭০ বা তার আগেও মেয়েরা স্লিভলেস ব্লাউজ দেদারসে পরতো, তারা কি সংস্কৃতির বাইরে?
আর বাংলা সংস্কৃতি কোন মৌলিক সংস্কৃতি না।
আমাদের বাংলা ভাষাটা পর্যন্ত মৌলিক না।

বাংলা ভাষা যেহেতু সংস্কৃত ভাষার মৌখিক রূপ প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন, সে কারণে এ ভাষার শব্দাবলীর প্রধান ভাগই হয় সংস্কৃত, নয়তো সংস্কৃত শব্দের বিবর্তিত রূপ (যেমন চন্দ্র থেকে চাঁদ)। তবে এ অঞ্চলের আদি ভাষাগুলোর কিছু শব্দও বাংলায় রয়ে গেছে (যেমন চাউল, ঢেঁকি)।

স্থানীয় ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্যও বহিরাগত বাংলাকে প্রভাবিত করেছে (যেমন, কোনো কোনো ক্রিয়া-বিভক্তিতে)। মুসলিম শাসন বাংলা ভাষাকে প্রভাবিত করেছিলো দুভাবে। প্রথমত, এ সময়ে বাংলা ভাষায় হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে। দ্বিতীয়ত, যে বাংলাকে সেনরা অবহেলা করেছেন এবং ব্রাহ্মণরা ঘৃণা করেছেন, সুলতানরা পনেরো শতক থেকে তারই পৃষ্ঠপোষণা করতে আরম্ভ করেন।

সতেরো/আঠারো শতকে কিছু পর্তুগিজ শব্দও বাংলা ভাষায় এসে যায় (যেমন আনানাস)। বিদেশী ভাষার ঢেউ আর একবার বাংলা ভাষায় লাগে ব্রিটিশ রাজত্ব স্থাপিত হওয়ার পর। সেই সুবাদে এখন বাংলায় কয়েক হাজার ইংরেজি শব্দ প্রতিদিনের শব্দে পরিণত হয়েছে। বাক্য-গঠনে এবং যতিচিহ্নেও (যেমন কমা, সেমিকোলোন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন) ইংরেজির প্রভাব রয়েছে।

২০২২ শে এসে যদি শিক্ষিত মানুষরা শুধু পোশাক নিয়ে সংস্কৃতি সংস্কৃতি বলে চিতকার করে তাহলে খুব দুঃখজনক। আগে জানতে হবে।

-ফেসবুক

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter