সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে চা শিল্পকে এগিয়ে নিতে

সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে চা শিল্পকে এগিয়ে নিতে

ব্যবসা-বাণিজ্যঃ

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকায় উন্নীত করার মতো এক মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চা সংসদের পক্ষ হতে এ ব্যাপারে গণমাধ্যম তথা দেশবাসীকে সবকিছু অবহিত করার লক্ষ্যে একটি প্রেস ব্রিফ সেশনের আয়োজন করা হয়েছে।

উল্লিখিত প্রেস ব্রিফটি ৩০ আগষ্ট, ২০২২ তারিখে গুলশান ১ এ অবস্থিত পুলিশ প্লাজা কনকর্ড টাওয়ার ২ এর লেভেল ৬ এ অবস্থিত এম আনিস উদ দৌলা কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত হয়।

এই ব্রিফিংয়ে অংশ নেন বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ এবং এতে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকগণ।

এই প্রেস ব্রিফে মূলত দেশের চা বাগানগুলোর বর্তমান অবস্থা, চা শিল্পের বিভিন্ন দিক, চা শ্রমিকদেরকে প্রদত্ত নানা সুযোগ-সুবিধা ও সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে সম্প্রতি দৈনিক মজুরিকে কেন্দ্র করে চা শিল্পে ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত অচলাবস্থা ও অস্থিরতা প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানানো হয়।

বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস যেমন প্রাচীন, তেমনি সমৃদ্ধ। প্রায় দুইশত বছরের পুরানো এই চা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চা বাগানের মালিকগণ , চা শ্রমিকেরা ও দেশের আপামর জনসাধারণ।

চা বাগানগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই সেখানে উন্নত মানের চা উৎপাদিত হয়ে আসছে। একেবারে প্রথম থেকেই চা শ্রমিকদের জন্য পরিকল্পিত ভাবে আবাসস্থল গড়ে তোলা হয় চা বাগানগুলোর অধীনেই যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ের বেশিরভাগ অভিবাসী চা শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারবর্গ বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন।

১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান স্থাপিত হয় যেখানে চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।

চা শিল্প একেবারে প্রথম থেকেই একটি কল্যাণমূখী শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। চা শ্রমিকেরা সকলেই চা বাগানে পরিবারের সদস্যের মতো। বাগানের মালিকানায় ও অর্থায়নে তাদের জীবনের চলার পথে সকল চাহিদা পূরণ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকে সবসময়।

বর্তমান মজুরির ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চা শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম নগদ মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৪১% বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত মজুরি মেনে নিয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে নগদ ও অনগদ দৈনিক পারিশ্রমিকসহ মোট মজুরি ৫০০ টাকার উপরে গিয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষ ভাবে আমরা উল্লেখ করতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কথা যিনি করোনা মহামারীকালে বলিষ্ঠ ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

চা শিল্প চালু রেখে এই শিল্পের সক্ষমতা ও শ্রমিকদের আয় এবং চাকুরির নিরাপত্তা বিধান করেন। চা বাগান এলাকায় করোনা কালে করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিলনা বললেই চলে এবং প্রায় শতভাগ শ্রমিক ও বয়ষ্ক পোষ্যরা আজ বিনামূল্যে করোনা টিকা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিবিএর সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ১৯৪৮ সাল থেকে চা শিল্পের উদ্যোক্তারা বাগানের সকল শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছেন। প্রতি সপ্তাহে একজন শ্রমিককে ন্যুনতম ৮কেজি করে রেশন ( চাল বা আটা) দেয়া হয়।

পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় সেটা সপ্তাহে ১৩ কেজি পর্যন্ত হয়। একজন শ্রমিক নামমাত্র মূল্যে প্রতি কেজি ২ টাকা হিসেবে চাল বা আটা ক্রয় করেন। সে হিসেবে প্রতি মাসে একজন শ্রমিক পরিবার গড়ে ৪২ কেজি পর্যন্ত রেশন পেয়ে থাকেন। শ্রমিকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাগানের মোট আয়তনের প্রায় ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯৪ হাজার বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য চা শ্রমিকেরা ব্যবহার করে আসছেন।দেখা গেছে, একটি বাগানের প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিকই এই সুবিধা ভোগ করছেন।

বাসস্থানের প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশের চা শিল্পে আনুমানিক ৭০,০০০ পাকা ও সেমিপাকা কোম্পানি প্রদত্ত ঘরে প্রায় রক লক্ষের উপর শ্রমিক পরিবারসহ বসবাস করেন।

এছাড়াও চা বাগানের জমিতে শ্রমিক পরিবারের বর্ধিত সদস্যবৃন্দ নিজস্ব ব্যয়ে নির্মিত ঘর বাড়িতে বসবাস করে থাকেন।

চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধুমাত্র শ্রমিক নিজেই এই সুবিধা পান।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শ্রমিকদের মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চা শিল্পে ২ টি বড় আকার্র আধুনিক গ্রুপ হাসপাতাল এবং ৮৪ টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫ টি ডিসপেনসারিসহ সত্রবমোট ৮৯০ জনের অধিক মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন।

১৬৮ বছরের পুরানো শিল্প হিসেবে চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোন শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই শ্রম আইন অনুসরণপূর্বক ৭০ দশকে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সম-কাজ এবং সম-মজুরি নিশ্চিত করেছে।

স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে নারীদের সমঅধিকার প্রদানে চা শিল্প প্রথম পদক্ষেপ নেয়। চা শিল্পে ১৯৩৯ সাল থেকে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আইন নির্ধারিত মাতৃকালীন ভাতা দিয়ে থাকেন। চা বাগানগুলো গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করছে যা বাংলাদেশে প্রচলিত অন্য যেকোন শিল্পে বিরল। সর্বোপরি সবদিক থেকেই চা শিল্প অনেক আগে থেকে সুসংগঠিত একটি শিল্প।

আশার কথা, বাংলাদেশের চায়ের ফলন অত্যন্ত সন্তোষজনক। গত বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে উৎপাদিত চায়ের বার্ষিক মূল্যমান প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা। হিসেবে প্রতি কেজি চা উৎপাদন খরচ যেখানে ২০২ টাকার মতো, সেখানে প্রতি কেজি চায়ের নিলাম মূল্য ২০০ টাকা মাত্র। বিগত দশ বছরে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে সর্বাধিক ৭৩.৯১ শতাংশ এবং গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এমতাবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে কর্মবিরতির মতো সিদ্ধান্ত চা শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছে।

চা শিল্প আমাদের সকলের। দেশের সরকার, চা বাগান মালিক, চা শ্রমিক ও আপামর জনসাধারণসহ সকলের ঐকান্তিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই শিল্পে উত্তোরত্তর টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। চা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই দেশে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে চায়ের রেকর্ড ফলন হয়েছে যার পরিমাণ ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিরও বেশি। সারা বিশ্বে চা উৎপাদনে দশম স্থানে আছে বাংলাদেশ। এরূপ সম্ভাবনাময় একটি শিল্পকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের সকলকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

-শিশির

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter