বিশ্ব রাজনীতির বেড়াজালে বাংলাদেশ

বিশ্ব রাজনীতির বেড়াজালে বাংলাদেশ

রোখসানা রফিকঃ

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী জানুয়ারী, ২০২৪ সালে দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জাতীয় সম্পদ পাচারকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপর স্যাংশন, মানে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফলশ্রুতিতে অসম্ভব চাপের মুখোমুখি হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতির চরম অস্থিরতার সময়ে। পুরো পৃথিবী জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র মনোপলি, খানিকটা হ্রাস পেয়েছে এশিয়ায় পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সম্ভাবনায়। বহুদিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব বেশি প্রকটিত অবস্থান না নিয়ে, চীন প্রথমে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। বিশ্বের পন্য বাজারের অনেক ক্ষেত্রই এখন চীনের করায়ত্বে। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তৈরীতে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং অর্থনৈতিক ঋণ ও সহযোগীতা প্রদান করার মাধ্যমে, ইতিমধ্যেই চীন তাদের কাছে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের পরিচিতি মজবুত করে নিয়েছে।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগীতা প্রদান করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের পুরনো প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে বেশ খানিকটা কোনঠাসা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু চীন এবং রাশিয়া পরীক্ষিত বন্ধু হওয়ায় পুরোপুরি জুত করে উঠতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলশ্রুতিতে চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে সম্পর্ক, আরও জোরদার করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিজেদের একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রাখতে সচেষ্ট ইঙ্গ-মার্কিন বলয়।

বিশ্ব রাজনীতির দাবার ছকে ঠিক এই পয়েন্টে এসে, বহুলাংশে গুরুত্ব বেড়ে গেছে বাংলাদেশ নামক ৩ দিকে সাগর পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র ব-দ্বীপ রাষ্ট্রটির। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অপর পক্ষে এদেশের বিরোধী দল বিএনপির বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানের, নিজেদেরই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে অস্থির ও নিম্নগামী। এদিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

কিন্তু এদেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, পদ্মাসেতুর অর্থায়নে অস্বীকার করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে, দূরত্ব তৈরী হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এই সুযোগ লুফে নিয়েছে নিয়েছে চীন। বাংলাদেশের বহুমুখী উন্নয়নে চীন অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে।

ঠিক এখানটাতেই জমে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা করার মাধ্যমে, ভারত যেমন তাদের দেশের দুই দিকের সীমান্ত থেকে, পাকিস্তানি শক্তি হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছিলো। ঠিক সেই একই হিসাবনিকাশে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত থাকায়, ভারতকে চাপের মুখে রাখার জন্য, বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন চীনের। অতএব, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠে বাংলাদেশ এখন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে মূলত চলছে ত্রিমুখী বৈশ্বিক শক্তির হারজিত ও স্বার্থরক্ষার খেলা। এর একটি পক্ষ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরেকটি পক্ষ হলো রুশ-ভারত শিবির, অপর একটি শক্তি হলো চীন এবং তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। রাশিয়ার সাথেও সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার কারণে চীনের সম্পর্ক ভালো। ভারত আছে চীন এবং রাশিয়ার মাঝখানে। আর সকল পক্ষেরই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।

মহাভারতের অর্জুন যেমন চক্রব্যুহে ঢোকার মন্ত্রটা শিখিছিলেন বটে, কিন্তু শেখেননি চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসার মন্ত্র। এর ফলে তাকে হারাতে হয়েছিল নিজের প্রাণ। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার, আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার ছকে বৃত্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে এগিয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার বন্ধু এবং শত্রু উভয়ই একাকার। উদ্ভুত এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার মন্ত্র এখনো জানা নেই ক্ষমতাসীন দলের।

আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেমন স্যাংশনের চাপে রেখেছে এদেশের ক্ষমতাসীন দলকে, চীন রেখেছে দাদনের ফাঁদে। প্রতিবেশী ভারত সহায়তা করতে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রেই হাত-পা বাঁধা তাদের, নিজ দেশের স্বার্থে। কি হবে এই খেলার ফলাফল? কেউ তা জানে না!

কারণ, এদেশের বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের ৩/৪ মাস দূরত্বে, এখনো মাঠের আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারেনি। বরং তারা মুমূর্ষু অবস্থা থেকে আমেরিকান স্যাংশনের বলে বলীয়ান হয়ে, নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে থেকে মাঠ সরগরম করছে। একে গণ আন্দোলনে রূপ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই তাদের হাতে, প্রচুর সমর্থক থাকা সত্ত্বেও। অপরের বলে বলীয়ান হয়ে, খুব বেশিদূর এগুনো যায় না কোনো যুদ্ধক্ষেত্রেই। হোক সে জীবন যুদ্ধ, প্রণয় ঘটিত দ্বন্দ্ব অথবা রাজনীতির ক্ষমতার মাঠ।

ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, তাদের সামনে পড়ে আছে- বিশ্ব রাজনীতির ছকে নিজেদের মেধা, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দক্ষতা প্রমাণ করার কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ, দলমত নির্বিশেষে আমরা সকলেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। কিছু চোরচোট্টা এবং দালালদের হিসাবে না ধরলে, প্রিয় স্বদেশের ভালো আমরা সবাই চাই।

পৃথিবীর বুকে কোনো দেশ কতোটা সফল হবে, তা নির্ধারিত হয় তাদের Nation building and state building, এই দুটো ভিত কতোটা মজবুত তার উপর। Nation buling মানে জাতীয়তা বোধে বাঙালী সেরা। আর State building আমরা ১৯৭১ এ শুরু করে আজ দৃঢ় গাঁথুনির উপর দাঁড়িয়ে আছি বিধায়, দিনে দিনে ক্রমশ উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং হবে আমাদের দেশ, বাংলাদেশ। এটাই কাম্য দলমত নির্বিশেষে এদেশের প্রতিটি মানুষের।

——

Print Friendly, PDF & Email
FacebookTwitter